কুরআন কী বলে? মানব ভ্রূণের বিকাশঃ নুত্‌ফাহ থেকে আলাক্বাহ






আল-কুরআনে আল্লাহ্‌ সুব্‌হান-তাআ'লা মাতৃগর্ভে ভ্রূণ থেকে মানব শিশুর জন্ম পর্যন্ত বিকাশের পুর্ণাঙ্গ একটা ধারণা দিয়েছেন । ভ্রূণের এই রূপান্তরের বিভিন্ন ধাপগুলো বুঝাতে আল্লাহ্‌ কিছু শব্দ ব্যাবহার করেছেন; যেমন নুত্‌ফাহ, আলাক্বাহ, মুদ্‌গাহ, ই’জামা, লাহ্‌মা। তাফসীরকারগণ এই শব্দগুলোর অনুবাদ এবং ব্যাখ্যা বিভিন্ন ভাবে করেছেন । কুরআনের বিজ্ঞান বিষয়ক শব্দগুলোর অনুবাদের ক্ষেত্রেই সাধারণত এই ভিন্নতা দেখা যায় বেশি । কারণ আরবি শব্দের একাধিক অর্থ আছে এবং কোন অর্থটা বেশি উপযুক্ত তা নির্বাচন করা অনেক সময় কঠিন হয়ে পড়ে [1] । তাই এই শব্দগুলোর প্রকৃত অর্থ বুঝতে আমাদের বর্তমান তাফসীরকারগণের অনুবাদের পাশাপাশি আরও দেখতে হবে প্রাথমিক আরবীয় যুগে এই শব্দগুলো দিয়ে কী বুঝানো হতো । আর, এর জন্য আমাদের যেতে হবে Edward William Lane এর Arabic-English Lexicon এ [2]। উল্লেখ্য, Edward William Lane ১৮৬৩ সালে এই আরবি-ইংলিশ ডিকশনারিটি সংকলন করেন যাতে তিনি আরবি শব্দের অর্থ ও ব্যাখ্যার জন্য নিজস্ব ধ্যান-ধারণার আশ্রয় না নিয়ে প্রাচীন মধ্যযুগীয় আরবী অভিধান ব্যবহার করেন[3]। তাই তার ডিকশনারিটি কুরআনের শব্দগুলোর প্রাথমিক আরবীয় যুগের ব্যাখ্যা জানার জন্য একটি নির্ভরযোগ্য উৎস বিবেচিত হয় । যাহোক চলুন দেখি মানব ভ্রূণের বিকাশ সম্পর্কে আল-কুরআন কী বলছে ।

সুরক্ষিত আধার
পবিত্র কুরআনের সূরা আল-মু’মিনুন এ আল্লাহ্‌ বলেনঃ

অতঃপর আমি তাকে নুত্‌ফাহ রূপে এক সুরক্ষিত আধারে স্থাপন করেছি। [২৩:১৩]
ক্বর-রিম্‌ মাকি-ন’ বা ‘সুরক্ষিত আধার’ বলতে এখানে আল্লাহ্ মাতৃগর্ভের জরায়ুর সুরক্ষা ব্যবস্থার প্রতি ইঙ্গিত করেছেন । ভ্রূণ হতে একটি মানব শিশুর বিকাশের জন্য এটা এমনই এক নিরাপদ আধার যেটা মানুষের পক্ষে বাইরে তৈরি করা সম্ভব না । তাই আমরা দেখি নির্ধারিত সময়ের আগেই যেসব অপুষ্ট শিশু (immature baby) ভূমিষ্ঠ হয় তাদের মৃত্যুহার অনেক বেশি । মেডিকেল জরিপ অনুযায়ী ২২ সপ্তাহের একটি অপুষ্ট শিশুর মাতৃগর্ভের বাইরে বেঁচে থাকার সম্ভাবনা মাত্র ৯% [4]

মানব ভ্রূণের বিকাশ
এর পরের আয়াতে আল্লাহ্‌ বলেনঃ

তারপর আমি নুত্‌ফাতাহকে (পুরুষ এবং নারীর বীজ, শুক্রাণু, ডিম্বাণু) আলাক্বাহ-য় (জমাট রক্তপিন্ড) পরিণত করি, অতঃপর আলাক্বাহকে মুদ্‌গাহ (মাংসপিণ্ড)এ পরিণত করি, এরপর মুদ্‌গাহকে ই’জামায় (হাড়) পরিণত করি, তারপর ই’জামাকে লাহ্‌মা (মাংসপেশি) দিয়ে আবৃত করি । অতঃপর তাকে গড়ে তুলি অন্য এক সৃষ্টিরূপে । অতএব সর্বোত্তম স্রষ্টা আল্লাহ্‌ কত বরকতময় ! [২৩:১৪]
এই একটি আয়াতেই আল্লাহ্‌ মানব ভ্রূণ বিকাশের প্রধান পর্যায়গুলোর উল্লেখ করে দিয়েছেন । এই পর্যায়গুলো হলোঃ নুত্‌ফাহ (পুরুষ এবং নারীর বীজ, শুক্রাণু, ডিম্বাণু) => আলাক্বাহ (জমাট রক্তপিন্ড) => মুদ্‌গাহ (মাংসপিন্ড) => ই’জামা (হাড়) => লাহ্‌মা (মাংসপেশি) দিয়ে আবৃত করা ।

নুত্‌ফাহ
‘নুত্‌ফাহ’ (نُطْفَةٌ) শব্দটি আরবি ব্যাকরণগত ভাবে একটি স্ত্রী-বাচক শব্দ । এটি কুরআনের মোট ১২ বার ব্যাবহার হয়েছে । বেশিরভাগ বাংলা অনুবাদে শব্দটির অর্থ ‘শুক্র’ বা ‘শুক্রবিন্দু’ লেখা হয়েছে[5]। কিন্তু আমরা জানি, শুক্র বা শুক্রাণু শুধুমাত্র পুরুষের শুক্রাশয় থেকে নির্গত হয় এবং নারীর ডিম্বাণু সাথে শুক্রাণুর মিলন ছাড়া শুধু শুক্রাণু থেকে কোন মানব ভ্রূণ হবে না । আয়াতটিতে আল্লাহ্‌ বলেন ‘আমি নুত্‌ফাতাহ কে আলাক্বাহ-য় পরিণত করি’ । তাহলে বোঝা যাচ্ছে ‘নুত্‌ফাহ’ শব্দের অর্থ শুধু ‘শুক্র’ বা ‘শুক্রবিন্দু’ হবে না । চলুন দেখি প্রাথমিক আরবীয় যুগে এই ‘নুত্‌ফাহ’ শব্দটি দিয়ে কী বুঝানো হতো । Edward William Lane এর Arabic-English Lexicon এ ‘নুত্‌ফাহ’ শব্দটির অর্থ লেখা হয়েছে ‘Sperma (seed) of man and of a woman’ অর্থাৎ ‘পুরুষ এবং নারীর বীজ’ [6]। অন্য একটি উল্লেখযোগ্য আরবি-ইংলিশ অভিধানে এর শব্দটির অর্থ লেখা হয়েছে ‘Drop of fluid of parents’ অর্থাৎ ‘তরল ফোঁটা যা পিতা-মাতা থেকে নির্গত হয়’ [7] । সুতরাং, ‘নুতফাহ’ শব্দটি দিয়ে শুধু পুরুষের শুক্রাণু না; বরং পুরুষ এবং নারীর যথাক্রমে শুক্রাণু ও ডিম্বাণু দুটিই বুঝানো হয়েছে । অন্য একটি আয়াতে আল্লাহ্‌ বলেনঃ 

নিশ্চয়ই আমি মানুষকে সৃষ্টি করেছি সংমিশ্রিত নুত্‌ফাহ থেকে তাকে পরীক্ষা করার জন্য; এজন্য তাকে করেছি শ্রবণ ও দৃষ্টিশক্তিসম্পন্ন । [৭৬:২]
এই আয়াতে আল্লাহ্‌ বলেন মানুষকে সৃষ্টি করেছেন ‘সংমিশ্রিত নুত্‌ফাহ’ থেকে । অর্থাৎ শুক্রাণু ও ডিম্বাণুর মিশ্রণ থেকে । শুক্রাণু ও ডিম্বাণুর মিলনে নিষিক্ত হয়ে ‘জাইগোট’ তৈরি হয় [চিত্র 1 এ step-2] (যাকে fertilization বলা হয়)। তাই বোঝা যাচ্ছে ‘নুত্‌ফাহ’ শব্দটি দিয়ে আসলে নিষিক্ত ডিম্ব বা ‘জাইগোট’ কেই ইঙ্গিত করা হয়েছে [আল্লাহ্‌ আ’লাম] ।
ডিম্ব নিষিক্ত হওয়ার ৬ষ্ঠ দিনে এটি ফেলোপিয়ান টিউবের মধ্য দিয়ে অতিক্রম করে জরায়ুতে এসে সংযুক্ত (যাকে implantation বলা হয়) হয় [8]। এখানে ভ্রূণের নতুন একটা পর্যায় শুরু হয়; যাকে আল্লাহ্‌ কুরআনে  বলছেন ‘আলাক্বাহ’ ।

আলাক্বাহ
‘আলাক্বাহ’ (عَلَقٌ) শব্দের বাংলা অর্থ প্রায় সব অনুবাদকই লিখেছেন ‘জমাট রক্তপিণ্ড’ (blood clot) । কিন্তু এই অর্থটি ছাড়া প্রাথমিক আরবীয় যুগের আরও যে অর্থগুলো পাওয়া যায় সেগুলো হলঃ ঝুলন্ত (suspended thing), আঠার মতো লেগে থাকে যা (clinging/ skicky substance), জোঁক (leech) [9]। চমকপ্রদ বিষয় হচ্ছে মানব ভ্রূণের এই পর্যায় সম্পর্কে আধুনিক বিজ্ঞান যা বলে তার সাথে এই সবগুলো অর্থই মিলে যায় ! যেমন, এটি দেখতে জমাট রক্তপিণ্ড এর মতো, এটি ঝুলন্ত ভাবে জরায়ুর গায়ে আঠার মত লেগে থাকে এবং জরায়ু থেকে পুষ্টি গ্রহণ করে যেমনটা জোঁক অন্য প্রাণীর শরীর থেকে রক্ত শুষে নেয় (২য় ছবি)। আরও মজার ব্যাপার, প্রাথমিক পর্যায়ে ভ্রূণ দেখতে আকৃতিগত ভাবে জোঁকের মতই (নিচের ছবি) ।



চলবে ইনশা-আল্লাহ ...

*****************************************
[1] তবে বিস্ময়কর ব্যাপার হল আমরা যেই অর্থই নেই না কেন তা কোন না কোন ভাবে সঠিক । এটা আল-কুরআনের একটা মুযেযা ।
[2] Lane, E. W. (1863). Arabic-English Lexicon.London, England: Willams & Norgate.
[3] Wikipedia. (2020, 5 8). Arabic-English Lexicon. Retrieved from https://en.wikipedia.org/wiki/Arabic-English_Lexicon
[4] Mark A Curran, M. F. (2019, 3 31). Fetal Development. (F. I. Technology, Producer) Retrieved from http://perinatology.com/Reference/Fetal%20development.htm
[5] বাইয়ান ফাউন্ডেশন এর অনুবাদে অবশ্য ‘নুত্‌ফাহ’ শব্দের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে ‘নারী ও পুরুষের যৌথ বীর্য, যা ভ্রূণে পরিণত হয়’ ।
[6] Lane, E. W. (1863). Arabic-English Lexicon. Retrieved from http://lexicon.quranic-research.net/data/25_n/165_nTf.html
[7] Ali, D. M. (2005). A Word-for- Word Meaning of the Qur'an. Jam'iat Ihyaa' Minhaaj al-Sunnah Ipswich (JIMAS), London.
[8] Mark A Curran, M. F. (2019, 3 31). Fetal Development. (F. I. Technology, Producer) Retrieved from http://perinatology.com/Reference/Fetal%20development.htm
[9] Arabic-English Lexicon by Edward William Lane, page-2134. http://lexicon.quranic-research.net/data/18_E/184_Elq.html
***********************************

No comments:

Post a Comment