ব্যাকরণ হচ্ছে ভাষার মেরুদণ্ড । ভাষাকে সুদৃঢ়, সুসংহত করতে, একে সুশৃঙ্খল নিয়মের মধ্যে বাঁধতে হয় । আর এই নিয়মগুলোই হলো ব্যাকরণ । তাই কোন ভাষায় দক্ষতা অর্জন করতে হলে সেই ভাষার ব্যাকরণেও দক্ষ হতে হয় । আল-কুরআনের ভাষা আরবি । অতএব, কুরআনকে ভালোভাবে বুঝতে হলে কুরআনের শব্দগুলোর সাথে পরিচয়ের পাশাপাশি আমাদের আরবি ভাষার ব্যাকরণও জানতে হবে । অন্যান্য ভাষার মত আরবি ভাষারও একটি সুশৃঙ্খল ব্যাকরণ আছে । তবে, যেমনটা ২য় অধ্যায়ে উল্লেখ করা হয়েছে যে অন্যান্য ভাষার তুলনায় আরবি ভাষার ব্যাকরণ অনেক বেশি সমৃদ্ধ ও সুশৃঙ্খল । যাই হোক, বাংলা ব্যাকরণের সাথে আরবি ব্যাকরণের কিছু মৌলিক পার্থক্য আছে । যেমন, আরবি ভাষায় বচন তিন প্রকারঃ একবচন, দ্বিবচন এবং বহুবচন (দুইজনের বেশি) । কিন্তু বাংলা ভাষায় দ্বিবচনের কোন ধারনা নেই । আরবি ভাষায় সর্বনামের পুরুষবাচক এবং স্ত্রীবাচক শব্দ (ইংরেজীhe/she এর মত) আছে যা বাংলাতে নেই । আরবিতে কাল মাত্র দুটি; অতীত কাল (যা ইতোমধ্যেই শেষ হয়ে গেছে বা ঘটে গেছে) এবং বর্তমান-ভবিষ্যৎ কাল (যা এখনও শেষ হয়নি, চলছে বা চলবে) । এই পার্থক্যগুলোর কারণে আসলে আল-কুরআনকে সঠিকভাবে বাংলায় অনুবাদ করা যায় না । তাই, আল-কুরআনকে সঠিকভাবে বুঝতে হলে আমাদের আরবি ব্যাকরণের নিয়মগুলো জানতে হবে । এই অধ্যায়ে আমরা আরবি ব্যাকরণের বেশি দরকারি কিছু নিয়ম জানব, ইনশা-আল্লাহ । সহজভাবে বুঝার জন্য এবং সহজে মনে রাখার জন্য এই নিয়মগুলো কয়েকটি রঙিন ছকের মাধ্যমে একটা সাধারণ (common) ফরমেটে (চিত্র-৭.১) উপস্থাপন করা হলো । শুদ্ধভাবে কুরআন বুঝতে এই ছকগুলো মুখস্ত করার কোন বিকল্প নেই ।
চিত্র ৭.১ এই অধ্যায়ে ব্যাকরণের নিয়মগুলো যে সাধারণ ফরমেটে সাজানো হল
এই অধ্যায়ে যা জানবো -
# আরবিতে কয় ধরনের বচন, সর্বনাম ও ক্রিয়ার কাল আছে ?
# বচন, লিঙ্গ ও কাল ভেদে শব্দ কিভাবে পরিবর্তিত হয় ?
# আরবি শব্দের শেষ বর্ণে যুক্ত স্বরকার দেখে কারক-বিভক্তি সহ আর কী কী বুঝি ?
বচন
আমরা জানি আরবি ব্যাকরণে বচন তিন প্রকারঃ একবচন, দ্বিবচন এবং বহুবচন (দুইয়ের বেশি) । বহুবচন আবার দুই ধরনের; সুগঠিত বহুবচন (Sound Plural) এবং ভঙ্গুর বহুবচন (Broken Plural) । সুগঠিত বহুবচন হচ্ছে শব্দকে বহুবচন করার সময় শব্দের মূলের বর্ণগুলোর অবস্থান পরিবর্তন হয় না । আর ভঙ্গুর বহুবচন এ শব্দমূলের বর্ণগুলোর অবস্থান পরিবর্তন হয় । মূল বর্ণের মাঝে, আগে বা পরে অন্য বর্ণ বসে শব্দকে বহুবচন করতে হয় । ছক-৭.১ এ ১টি ব্যক্তি; হা-মিদ (প্রশংসাকারী) এর লিঙ্গ ও বচন ভেদে কিভাবে পরিবর্তিত হয় তা দেয়া হল । মূলত, শব্দের শেষে বিভিন্ন বর্ণ যুক্ত হয়ে সুগঠিত বহুবচন তৈরি হয় । এগুলোর গঠনগুলো মনে রাখতে পারলে আমরা অন্যান্য ব্যক্তি/বস্তুর ক্ষেত্রেও পারব ইনশা-আল্লাহ্ । ছক-৭.২ এ ভঙ্গুর বহুবচনের কয়েকটি উদাহরণ দেয়া হলো (আল-কুরআনের আয়াত নং সহ) ।
ছক -৭.১ ব্যক্তি/বস্তু (object) এর বচন ভেদে বিভিন্ন রূপ
সর্বনাম
আল-কুরআনে কোন বিষয়ে কে কাকে কার সম্পর্কে বলা হচ্ছে তা সঠিক ভাবে বুঝার জন্য আমাদের আরবি এই সর্বনাম (pronoun) গুলো মনে রাখতে হবে । এগুলো স্বাধীন ভাবে থাকে (মুক্ত সর্বনাম) বা শব্দের শেষে যুক্ত (যুক্ত সর্বনাম) ভাবে থাকে । যুক্ত সর্বনাম যদি বিশেষ্য (noun) এর সাথে যুক্ত থাকে তাহলে অধিকার (possesions) বুঝায়; যেমন আমার, তোমার, তার, তাদের । ১টি উদাহরণ দেখিঃ
رَبَّهُمْ = (তাদের (পুং) রব (Noun) (১০০:১১
আর যদি ক্রিয়া (verb) এর সাথে যুক্ত থাকে তাহলে কর্ম (object) বুঝায়; যেমন আমাকে, তোমাকে, তাকে, তাদেরকে । ১টি উদাহরণ দেখিঃ
آتَاهُمْ = (তাদেরকে (পুং) দিবেন (Verb) (৫১:১৬
আল-কুরআন থেকে আরো কিছু উদাহরণ দেখিঃ
رَبُّكَ = (তোমার (পুং) রব (১০৫:১
رَبِّكِ = (তোমার (স্ত্রী) রবের (৮৯:২৮
رَبَّهُ = (তার (পুং) রব (৯৮:৮
رَبِّي = (আমার রব (৮৯:১৬
لِرَبِّهَا = (তার (স্ত্রী) রবের জন্য (৮৪:৫
رَبُّكُمُ = (তোমাদের (পুং) রব (৭৯:২৪
رَبِّنَا = (আমাদের রবের (৭৬:১০
رَبِّكُمَا = (তোমাদের উভয়ের (দ্বিবচন) রবের (৫৫:৭৭
উপরের ছকে লক্ষ্য করুনঃ
# প্রতিটি মোটা দাগের ঘরে উপরের সারিতে পুরুষ-বাচক এবং নিচের সারিতে স্ত্রী-বাচক সর্বনাম । বামের কলামে যুক্ত সর্বনাম যা শব্দের শেষে যুক্ত থাকে এবং ডানের কলামে মুক্ত সর্বনামগুলো রাখা হয়েছে ।
# উত্তম পুরুষ (1st person) যেমন 'আমি', 'আমরা', 'আমার', বা 'আমাদের' এর দ্বিবচন নেই এবং পুরুষ বা স্ত্রী বাচক কোন ভেদ নেই ।
# মধ্যম পুরুষ (2nd person) যেমন 'তুমি', 'তোমার' এবং নামপুরুষ (3rd person) যেমন 'সে', 'তার' এগুলোর দ্বিবচনের জন্য পুরুষ বা স্ত্রী বাচক কোন ভেদ নেই ।
ক্রিয়ার কাল
আরবি ব্যাকরণে কাল দুটি; অতীত কাল (যা ইতোমধ্যেই শেষ হয়ে গেছে বা ঘটে গেছে) এবং বর্তমান-ভবিষ্যৎ কাল (যা এখনও শেষ হয়নি, চলছে এবং ভবিষ্যতে চলবে) । শব্দে কর্তা বা সর্বনামের অবস্থান দেখে আমরা ক্রিয়ার কাল বুঝতে পারি । কর্তা বা সর্বনাম যদি ক্রিয়ার পরে থাকে তবে অতীত কাল এবং যদি আগে থাকে তবে বর্তমান-ভবিষ্যৎ কাল নির্দেশ করে । এই অনুচ্ছেদে আমরা বিভিন্ন সর্বনামের এবং বিভিন্ন বচনের জন্য ১টি ৩-বর্ণের ক্রিয়া; নাসারা (সাহায্য করা) এর বিভিন্ন রূপগুলো দেখবো । এই নিয়মগুলো সাধারণ ভাবে ২-বর্ণের ক্রিয়ার জন্যও প্রযোজ্য হবে । অধ্যায়-৪ এর ছক-৪.১ এ ২-বর্ণের ১টি ক্রিয়ার কিছু উদাহরণ আমরা দেখেছিলাম ।
নিচের ছকটি থেকে আরবি ১টি ক্রিয়ার ৩টি বচন (একবচন, দ্বিবচন, বহুবচন), ৩টি পুরুষ (আমি, তুমি, সে) এবং Active, Passive মিলিয়ে অতীত কালের জন্য মোট ১৪x২=২৮টি রূপ জানবো ইংশা-আল্লাহ ।
ছকটির �প্রতিটি ঘরে লক্ষ্য করুনঃ বুঝার সুবিধার্থে ডানে আরবি সর্বনাম গুলো (আনা, আনতা, হুয়া.. ইত্যাদি) দেয়া হলো যেগুলো বাক্যে নাও থাকতে পারে । মূল ক্রিয়া-বাচক (মাঝ খানে) শব্দের শেষে যুক্ত বর্ন (লাল চিহ্নিত) দেখেই কর্তা কে বুঝা যাবে ।
এবার দেখা যাক বর্তমান-ভবিষ্যৎ কালের কিছু উদাহরণ । কর্তা বা সর্বনাম যদি ক্রিয়ার আগে থাকে তবে বর্তমান-ভবিষ্যৎ কাল নির্দেশ করে । নিচের ছকটি থেকে আমরা আরবি ১টি ক্রিয়ার ৩টি বচন (একবচন, দ্বিবচন, বহুবচন), ৩টি পুরুষ (আমি, তুমি, সে) এবং Active, Passive মিলিয়ে মোট ১৩x২=২৬টি রূপ জানবো ইংশা-আল্লাহ ।
ছকটির �প্রতিটি ঘরে লক্ষ্য করুনঃ বুঝার সুবিধার্থে ডানে আরবি সর্বনাম গুলো (আনা, আনতা, হুয়া.. ইত্যাদি) দেয়া হলো যেগুলো বাক্যে নাও থাকতে পারে । মূল ক্রিয়া-বাচক শব্দের আগে যুক্ত বর্ন (সবুজ চিহ্নিত) দেখেই কর্তা কে বুঝা যাবে এবং শব্দের শেষে যুক্ত বর্ণ (লাল চিহ্নিত) দেখে বচন বুঝা যাবে ।
উপরের ছকে লক্ষ্য করুন
১। শব্দের আগে ‘হামযাহ/আলিফ’ থাকলে কর্তা হবে আমি ।
২। শব্দের আগে ‘নুন’ থাকলে কর্তা হবে আমরা ।
৩। শব্দের আগে ‘ইয়া’ থাকলে কর্তা হবে সে/তারা(পুং) অথবা তারা(বহুবচন-স্ত্রী) ।
৪। শব্দের আগে ‘তা’ থাকলে কর্তা হবে তুমি/তোমরা (পুং/স্ত্রী) অথবা সে/তারা(একবচন/দ্বিবচন স্ত্রী) ।
৫। কর্তা পুরুষ না স্ত্রী সেটা পুরো বাক্য দেখে বুঝা যাবে । বাক্যে যদি স্ত্রী বাচক অন্য কোন শব্দ থাকে তবে কর্তা হবে স্ত্রী; অন্যথায় কর্তা হবে পুরুষ ।
৬। কর্তার বচন জানতে শব্দের শেষে যুক্ত বর্ণ দেখতে হবে । শব্দের শেষে “আলিফ+নুন” থাকলে দ্বিবচন নির্দেশ করে (ছক-৭.১) আর “নুন” অথবা “ওয়াও+নুন” থাকলে বহুবচন নির্দেশ করে ।
আগের দুটি ছকে আমরা দেখলাম কালের সাথে ১টি ক্রিয়া কিভাবে পরিবর্তিত হয় । এখন আমরা দেখবো এই ক্রিয়াটি থেকে আর কী কী দরকারি শব্দ তৈরি হতে পারে যার সাথে সময় বা কালের কোন সম্পর্ক নাই । যেমন, ক্রিয়াটির নাম (সাহায্য), কর্তা বা যিনি কাজটি করেন (সাহায্যকারী) , যার উপর কাজটি আপতিত হয় (সাহায্যপ্রাপ্ত), কাজটির আদেশ (সাহায্য করো), নিষেধ (সাহায্য করো না) ইত্যাদি । নিচের ছকটি দেখুন ।
কারক ও বিভক্তি
কতগুলো শব্দ পাশাপাশি রেখে দিলেই একটি বাক্যে হয় না । একটি অর্থবোধক বাক্য তৈরি করতে একটি শব্দের সাথে আরেকটি শব্দের সম্পর্ক স্থাপন করতে হয় । এই সম্পর্ক স্থাপনের জন্য শব্দের শেষে যে শব্দাংশ যুক্ত করতে হয় তাকে বিভক্তি বলে । আর কারক হচ্ছে ক্রিয়া-বাচক শব্দের সাথে অন্যান্য শব্দের যে সম্পর্ক । নিচের বাক্যটি লক্ষ্য করুন । নাম-বাচক শব্দের সাথে “কে”, “এর” বিভক্তি যুক্ত করতে হয়েছে বাক্যটিকে অর্থপুর্ণ করতে ।
তবে কারক বিভক্তি চিনতে বাংলায় যেমন দেখতে হয় নাম-বাচক শব্দের শেষে যুক্ত অতিরিক্ত এক বা একাধিক বর্ণ, আরবিতে তেমন নয় । আরবিতে কারক বিভক্তি চেনা যায় নাম-বাচক শব্দের শেষ বর্ণের স্বরকার দেখে । যেমন শব্দের শেষ বর্ণে
· ক) যবর / ফাত্হা থাকলে কর্ম বাচক, দ্বিতীয়া বিভক্তি (কে, রে, এরে)
· খ) যের / কাস্রা থাকলে সম্বন্ধ সূচক, ষষ্ঠী বিভক্তি (র, এর)
· গ) পেশ / দম্মা থাকলে কর্তৃ বাচক, শূন্য বিভক্তি
শব্দের শেষ বর্ণে যুক্ত স্বরকার দিয়ে বিভিন্ন বিভক্তি প্রকাশ ছাড়া আরও কিছু ব্যাবহার আছে যা ছক-৬.৬ এ উদাহরণসহ দেখানো হলো । যেমন, ক্রিয়ার শেষ বর্ণে যজম/সুকুন থাকলে আদেশ (command) বুঝায় ।
ব্যাকরণের সহজ পাঠগুলোর পাশাপাশি চলুন দেখা যাক এই অধ্যায়ে নতুন কী কী শব্দ (সর্বনাম ছাড়া) চিনলামঃ

এই অধ্যায়ে আরবি ব্যাকরণের সাধারণ কিছু নিয়ম সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো । তবে মনে রাখতে হবে যে কুরআনের ভাষাগত সৌন্দর্য এবং কুরআনের ব্যাকরণগত মিরাকলগুলো বুঝতে আমাদের আরবি ব্যাকরণের খুঁটিনাটি বিস্তারিত নিয়মকানুনগুলোও জানতে হবে ।
******************************************************************************
PDF download এর জন্য এখানে ক্লিক করুন
আগের অধ্যায় ৬। কোরআনের নামবাচক শব্দ
পরের অধ্যায় ৮। আরবি শব্দমূল থেকে কুরআনের শব্দ শিখি
******************************************************************************
আল-কুরআনের সর্বাধিক ব্যবহৃত শব্দগুলোর ছবি/PDF download করতে এখানে ক্লিক করুন
সর্বশেষ পরিমার্জন 26-12-2019
photos arent visible. Please check
ReplyDeleteAssalamu alaikum. Thanks for informing it. Now I have uploaded the images. Anyway you can download the whole book from the home page.
Delete