অনন্য এক মহা-গ্রন্থ আল-কোরআন; আল্লাহ্ এঁকে নাজিল করেছেন সমগ্র মানবজাতির সঠিক পথ নির্দেশের জন্য । সমগ্র মানবজাতির জন্য হলেও আল্লাহ্ কোরআনের ভাষা হিসাবে নির্বাচন করেছেন আরবিকে । কিন্তু কেন ? আরবি ভাষার আছে কি কোন বিশেষত্ব ? আল্লাহ্ কোরআনকে বুঝে পড়ার উপর গুরুত্ব আরোপ করেন এবং বলেন এটি আরবি ভাষায় যাতে আমাদের বুঝতে সহজ হয় । কিন্তু আরবি কি বুঝা সহজ ? হলে কতটা সহজ ?
এক অনন্য গ্রন্থ আল-কোরআন
আল-কোরআন এক অনন্য গ্রন্থ । এই অনন্যতা শুধু বিষয়বস্তুর কারণে নয় বিষয়বস্তুর উপস্থাপনের কারণেও । গতানুগতিক অন্যান্য গ্রন্থ যেমন ভূমিকা, আলোচ্য বিষয়ের বিস্তারিত ধারাবাহিক উপস্থাপনা এবং সবশেষে উপসংহার টেনে সমাপ্ত হয়, আল-কোরআন তেমনটা নয় । এখানে ভূমিকা ছাড়াই সরাসরি মূল বিষয়ের আলোচনা, ক্রমধারা অনুসরণ না করেই ঐতিহাসিক ঘটনাবলীর বর্ণনা, একই আয়াতে প্রায়ই বক্তা ও শ্রোতার পরিবর্তন ঘটেছে । তাই, প্রথম কেউ কোরআনের অনুবাদ পড়তে গেলে তার কাছে এটি এলোমেলো মনে হতে পারে । তবে সময়ের সাথে সাথে এমনটা আর মনে হবে না । আল-কোরআনের এমন অনন্য উপস্থাপনের একটা কারণ হতে পারে যে, পাঠক যখন কোরআনের কোন অংশ থেকে কয়েকটি বাক্য পড়ে তখন সে কোন না কোন একটা পুর্নাঙ্গ বার্তা পেয়ে যায়; তাকে কোরআনের প্রথম থেকে বা সূরার প্রথম থেকে পড়ে আসার দরকার পরে না । আর, কোরআনের প্রধান উদ্দেশ্যইতো হচ্ছে মানুষের কাছে আল্লাহ্র বার্তা পৌঁছানো ।
অর্থ বুঝে কোরআন পড়া কেন গুরুত্বপুর্ণ ?
নিজে নিজে অর্থ বুঝে কোরআন পড়তে না পারলে আমাদের কোরআনের বাংলা অনুবাদের সাহায্য নিতে হয় । আলহামদুলিল্লাহ, কোরআন অনুবাদের কাজে ইতিমধ্যে অনেক অনুবাদক এগিয়ে এসেছেন । তবে, উল্লেখ্য, আল-কোরআনের বাংলা অনুবাদের ক্ষেত্রে কোন কোন অনুবাদক আল-কোরআনকে শাব্দিক অনুবাদ করেছেন আবার কোন কোন অনুবাদক করেছেন ভাবার্থ অনুবাদ । শাব্দিক অনুবাদে আনুবাদকগন কোরআনের মূল শব্দের অর্থের কাছাকাছি বাংলা প্রতিশব্দের ব্যবহার করতে চেষ্ঠা করেন । সেক্ষেত্রে মাঝে মাঝে পাঠকগণের কাছে অনুবাদটি দুর্বোদ্ধ হয়ে যায় । প্রকৃতপক্ষে, কোরআনকে আক্ষরিকভাবে অনুবাদ করা যায় না । কারণ, অধিকাংশ আরবি শব্দেরই একাধিক অর্থ রয়েছে । ফলে অনুবাদকের জন্য সঠিক প্রতিশব্দ নির্বাচন কঠিন হয়ে পড়ে । অনেক সময় এতে কোরআনের অর্থেরও বিকৃতি ঘটে । আবার, অনেক শব্দের ভাল বাংলা প্রতিশব্দও পাওয়া যায় না । অন্যদিকে, ভাবার্থ অনুবাদের ক্ষেত্রে আনুবাদকগন সুবিধাজনক প্রতিশব্দ ব্যবহার করে কোরআনের ভাবার্থ ঠিক রাখতে চেষ্ঠা করেন । তবে এক্ষেত্রে, অনুবাদে অনেক সময় অনুবাদকের নিজস্ব চিন্তাধারা ও মতাদর্শের প্রতিফলন ঘটে যায় । আবার, ভাষার সীমাবদ্ধতার কারণেও কোরআনের সঠিক অনুবাদ করা যায় না । যেমন, আরবি ভাষায় বচন তিন প্রকারঃ একবচন, দ্বিবচন এবং বহুবচন । কিন্তু, বাংলা ভাষায় দ্বিবচনের কোন ধারনা নেই । আরবি ভাষায় সর্বনামের পুরুষবাচক এবং স্ত্রীবাচক শব্দ (ইংরেজীতেhe/she এর মত) আছে যা বাংলাতে নেই । ফলে দেখা যাচ্ছে, অনুবাদ পড়ে মূল কোরআন অনুধাবন করতে পাঠকের সমস্যা হয় । অতএব আমাদের উচিত কোরআনকে কোরআনের ভাষাতেই অনুধাবন করা ।
আল-কোরআন অবতীর্নের মাস, রমাদ্বানে সারা বিশ্বে লক্ষ কোটি বার কোরআন পড়া হয় এবং শোনা হয় । কিন্তু অর্থ বুঝে কতজন পড়েন বা শুনেন ? একাগ্রচিত্তে, অন্তর থেকে বুঝে কোরআন পড়লে, কী বিস্ময়কর অনুভূতিই না হয় ! একবার কুয়েতের গ্র্যান্ড মসজিদের ইমাম শেখ মিশারী রাশিদ আল-আফাসী রমাদ্বানের তারাবী নামায পড়াচ্ছিলেন । একটা জায়গায় এসে উনার কণ্ঠ ভারী হয়ে আসলো; কান্না শুরু করলেন ! কান্নার তীব্রতা এতই বেড়ে গেল যে এক পর্যায়ে, নামায পড়ানোই কঠিন হয়ে গেল তাঁর জন্য ! ইমাম একাই শুধু কাঁদছেন – তা নয়; সাথে বাকীরাও কাঁদছেন । ইমাম সাহেব পবিত্র কুরআন এর কোন অংশ পড়াচ্ছিলেন ? কী লেখা আছে সেখানে যার জন্য মসজিদের প্রায় প্রতিটি মানুষ ঢুঁকরে কেঁদে উঠছিলেন !? পবিত্র কুরআনের ৪১নং সুরা ফুসসিলাত এর আয়াত নং ১৯-৩৬ পড়ছিলেন তিনি । আখিরাতে জাহান্নামীদের কঠিন অবস্থার কথা বলা আছে । একজন সচেতন মুসলিম মাত্রই এই অংশটুকু মন দিয়ে পড়লে ভয়ে কাঁদতে বাধ্য । কী দুর্ভাগা আমরা ! কোরআন পড়ছি কিন্তু অর্থ না বুঝার কারণে তা আমাদের অন্তরকে স্পর্শ করছে না ।
আল্লাহ্ বলেন-
- “তোমরা নেশাগ্রস্ত অবস্থায় নামাযের কাছে যেও না; যতক্ষণ না তোমরা যা বলছো তা বুঝতে পারো ।” [নিসা ৪:৪৩]
আয়াতটি নাজিল হয়েছিল মাদককে নিষিদ্ধ করার ২য় পর্যায়ে (১ম পর্যায়ে মাদককে নিরুৎসাহিত করা হয়, তারপর একে নামাযে নিষিদ্ধ করা হয় এবং সবশেষে একে পুরোপুরি নিষিদ্ধ করা হয়) । মাদককে নিষিদ্ধ করার জন্য নাজিল হলেও আয়াতটি আমাদের আরও একটা গুরুত্বপুর্ন বার্তা দেয় । আর তা হলো নামাযে আমরা কী বলছি তা বুঝে বলা । একটু চিন্তা করুন … দিনের পর দিন আমরা তো অর্থ না বুঝে শুধু মুখস্ত করা কয়েকটা সূরা দিয়েই আমাদের নামায আদায় করছি । মদপান না করেও আমরা যেন নেশাগ্রস্তের মত নামায পড়ছি !! কিন্তু নামায তো হবে মেরাজ সরূপ; আল্লাহ্র সাথে বান্দার কথা বলা । কারো সাথে কথা বলতে গেলে কি আমরা না বুঝে কথা বলি ? অতএব, মহান আল্লাহ্র সাথে আত্মিক যোগাযোগ দৃঢ় করার জন্য আমাদের অবশ্যই অর্থ বুঝে নামায এবং সেই সাথে কোরআন পড়া উচিৎ ।
কেন আল-কোরআন আরবি ভাষায় ?
আল-কোরআনের ভাষা আরবি; এই বিষয়টি আল্লাহ আল-কোরআনের ১১টি স্থানে উল্লেখ করেছেন । যেমন আল্লাহ্ বলেনঃ
- “এমনিভাবে আমি আরবি ভাষায় কোরআন নাযিল করেছি এবং এতে নানাভাবে সতর্কবাণী ব্যক্ত করেছি, যাতে তারা আল্লাহভীরু হয় অথবা তাদের অন্তরে চিন্তার খোরাক যোগায় ।” [ত্বোয়াহা ২০:১১৩]
- “এই কোরআন তো বিশ্ব-জাহানের পালনকর্তার নিকট থেকে অবতীর্ণ । বিশ্বস্ত ফেরেশতা একে নিয়ে অবতরণ করেছে । আপনার অন্তরে, যাতে আপনি ভীতি প্রদর্শনকারীদের অন্তর্ভুক্ত হন । সুস্পষ্ট আরবি ভাষায় ।” [আশ-শুআরা ২৬:১৯২-১৯৬]
- “আরবি ভাষায় এ কোরআন বক্রতামুক্ত, যাতে তারা সাবধান হয়ে চলে ।” [আয-যুমার ৩৯:২৮]
- “এটা অবতীর্ন পরম করুনাময়, অসীম দয়ালুর পক্ষ থেকে । এটা কিতাব, এর আয়াতসমূহ বিবৃত আরবি কোরআন রূপে জ্ঞানী লোকদের জন্য ।” [ফুসসিলাত ৪১:২-৩]
কিন্তু কেন আল্লাহ কোরআনকে আরবি ভাষায় নাজিল করলেন ? অন্যতম একটি কারণতো এই যে, এটা নাজিল হয়েছে আরবে আর রসূল মুহাম্মদ (সাঃ) ছিলেন আরবি ভাষী । যেমন আল্লাহ বলেনঃ
- “আমি যদি একে অনারব ভাষায় কোরআন করতাম, তবে অবশ্যই তারা বলত, এর আয়াতসমূহ পরিষ্কার ভাষায় বিবৃত হয়নি কেন? কি আশ্চর্য যে, কিতাব অনারব ভাষায় আর রসূল আরবি ভাষী !” [ফুসসিলাত ৪১:৪৪]
কিন্তু কোরআন তো শুধু আরবদের জন্য নয়; এটা নাজিল হয়েছে সমগ্র মানব জাতির পথ নির্দেশের জন্য । তাহলে, কোরআন কেন আরবি ভাষায় ? আরবি ভাষার কোন বিশেষত্ব নিশ্চয়ই আছে যার জন্য আল্লাহ এ ভাষাকে মনোনীত করলেন কোরআনের ভাষা হিসাবে । অন্যতম আরেকটি কারণ, অন্য ভাষায় চেয়ে আরবি ভাষা বুঝতে সহজ হয় । যেমন আল্লাহ বলেন,
- “আলিফ লা-ম-র; এগুলো সুস্পষ্ট গ্রন্থের আয়াত । আমি একে আরবি ভাষায় কোরআন রূপে অবতীর্ণ করেছি, যাতে তোমরা বুঝতে পার ।” [ইউসুফ ১২:১-২]
- “হা-মীম । শপথ সুস্পষ্ট কিতাবের । আমি একে করেছি কোরআন, আরবি ভাষায়, যাতে তোমরা বুঝ ।” [আয-যুখ্রুফ ৪৩:১-৩]
কিন্তু ভাষাবিজ্ঞানের বিচারে আর কী কী বিশেষত্ব আছে যা আরবি ভাষাকে অন্য ভাষার উপড়ে অনন্যতা দান করেছে ? চলুন অন্যতম কয়েকটি কারণ দেখি -
১। সময়ের সাথে আথে পৃথিবীর সব ভাষার বিবর্তন হয় । পরিবর্তন হয়ে হয়ে মূল উৎস ভাষার কোন অস্তিত্বই অনেক সময় থাকে না । যেমন সংস্কৃত ভাষা থেকে বাংলা, হিন্দি ভাষার উৎপত্তি হলেও মূল সংস্কৃত ভাষার এখন কোন অস্তিত্ব নেই । আবার সময়ের সাথে শব্দের অর্থেরও পরিবর্তন ঘটে । যেমন বাংলায় পূর্বে “সন্দেশ” বলতে ‘খবর/সংবাদ’ বুঝা হতো কিন্তু বর্তমানে এটি ছানা থেকে তৈরী এক ধরনের মিষ্টি । “ঝি” শব্দের পূর্বের অর্থ ছিল ‘কন্যা’ আর বর্তমানে এর অর্থ ‘পরিচালিকা’ । যা হোক, আরবি ভাষা এসেছে ২০০০ বৎসরেরও বেশি পুরাতন সিমাটিক ভাষা থেকে । তবে আশ্চর্যজনক ভাবে কোরআন অবতীর্নের পর গত ১৪০০ বৎসর এ আরবি ভাষা নিজেকে শুদ্ধ, অবিকৃত অবস্থায় ধরে রেখেছে । এর শব্দ ও শব্দমূল এমনকি এগুলোর অর্থের কোন পরিবর্তন হয়নি ।
২। আরবি ভাষায় আছে সবচেয়ে সমৃদ্ধ শব্দ ভাণ্ডার । সব ধরনের ভাব বা অবস্থা বুঝানোর জন্য এর ভিন্ন ভিন্ন শব্দ আছে । যেমন, উট (camel) কে বর্ণনা করতে আরবিতে ১০০০ এরও বেশি শব্দ আছে । ভালবাসা (love) প্রকাশ করতে আরবিতে ৬০টিরও বেশি শব্দ আছে । আর চমকপ্রদ বিষয় হচ্ছে প্রত্যেকটি শব্দেরই ভিন্ন ভিন্ন অর্থ আছে এবং অর্থ অনুসারে এদের ব্যবহারেরও ভিন্নতা আছে । বাংলায় “তারা” বললে বুঝা যায় না তারা কতজন; তারা পুরুষ না স্ত্রী ? আরবিতে “তারা” বুঝাতে আছে “হুম” (পুরুষ), “হুন্না” (স্ত্রী), “হুমা-” (দুইজন পুরুষ), “হা-তা-ন” (দুজন স্ত্রী) । অর্থাৎ আরবিতে বচন/লিঙ্গ অনুযায়ী ভিন্ন ভিন্ন সর্বনাম ব্যাবহার হয় । আরেকটি উদাহরণ দেখি । “ক্ষমা করা” বা “গুনাহ মাফ করা” অর্থে আরবিতে “গাফুর” বা “আফুউ” ব্যবহার করা হয় । যদিও শব্দ দুটির অর্থ একই কিন্তু ইসলামিক স্কলারগণ এই দুটি শব্দের মধ্যে অনেক পার্থক্য উল্লেখ করেছেন । কেউ কেউ বলেন যে, ফরজ ইবাদাত ছেড়ে দেওয়ার পর যদি ক্ষমা করা হয় তখন “আফুউ” ব্যবহার করা হয় আর হারাম কাজ করার পর ক্ষমা করলে তখন “গাফুর” শব্দটি ব্যবহার করা হয়। আবার কারো কারো মতে আল্লাহ তাআলার মাগফিরাতের অর্থ হচ্ছে আল্লাহ তাআলা আপনাকে ক্ষমা করে দিয়েছেন, কিন্তু আপনার গুনাহগুলো তারপরও লিপিবদ্ধ হয়ে থাকবে এবং বিচার দিবসে আপনাকে এর সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে। অর্থাৎ আপনাকে মাফ করা হয়েছে ঠিকই, কিন্তু বিচার দিবসের আগ পর্যন্ত সেগুলো মুছে ফেলা হবে না । অন্যদিকে “আফুউ” এর থেকেও অধিক মর্যাদাসম্পন্ন ক্ষমা।অর্থগত বিশ্লেষণ করলে আমরা দেখি যে, আরবরা সাধারণত “মুছে ফেলা” অর্থে “আফুউ” শব্দটি ব্যবহার করে থাকে । অর্থাৎ যখন আল্লাহ তাআলা আপনার গুনাহগুলো ক্ষমা করে দেবার পর তা পুরোপুরি মুছে ফেলেন। এমনকি বিচার দিবসেও সে সম্পর্কে কিছুই জিজ্ঞেস করা হবে না। আল্লাহ তাআলা বান্দা এবং ফেরেশতাদেরকেও এই গুনাহগুলোর কথা ভুলিয়ে দেন, যেন বিচার দিবসে আপনাকে এসব গুনাহর জন্য অপমানিত হতে না হয়। মানুষ তার পাপ কর্মের জন্য যখন একেবারে মন থেকে ক্ষমা চায়, তখন আল্লাহ অত্যন্ত খুশি হয়ে এই ধরণের ক্ষমা করে থাকেন । যেমন লাইলাতুল ক্বদরের মত অধিক মর্যাদাসম্পন্ন রাতে এই অধিক মর্যাদাসম্পন্ন ক্ষমা পাওয়ার জন্য আল্লাহ্ নিজেই আমাদেরকে একটা দু'আ শিখিয়ে দিয়েছেন । দু’আটি হলো- “আল্লাহুম্মা ইন্নাকা ‘আফুউন তুহিব্বুল ‘আফওয়া, ফা’ফু আন্নি।” অর্থাৎ “হে আল্লাহ, নিশ্চয়ই আপনি পরম ক্ষমাশীল এবং ক্ষমা করতে ভালোবাসেন, সুতরাং আমাকে ক্ষমা করে দিন (অর্থাৎ গুনাহগুলো একদম মুছে দিন) ।”
৩। আরবি ভাষার বর্ণমালায় কোন স্বরবর্ণ নেই । শুধু মাত্র ২৮টি (হাম্যা সহ ২৯টি) ব্যঞ্জনবর্ণ আছে । তবে, অনারবদের আরবি উচ্চারণের জন্য ৩টি স্বরচিহ্নের (ফাত্হা/যবর = আ-কার / া ; কাস্রা/যের = ই-কার / ি এবং দম্মা/পেশ = উ-কার / ু ) ব্যবহার করা হয় যদিও আরবি ভাষীদের বুঝতে স্বরচিহ্নের প্রয়োজন হয় না । এই ৩টি ছাড়া আরও ৩টি দীর্ঘ স্বরধ্বনি [ যেমন দীর্ঘ আ-কার (যবর+আলীফ) যা বাংলা ভাষায় নেই, ঈ-কার (যের+ইয়া) এবং ঊ-কার (পেশ+ ওয়াও) ] , ১টি হস্ ধ্বনি / সূকুন (বাংলায় হসন্ত / ্ ) এবং দ্বিত্ব ধ্বনি / তাশদীদ আছে । এত অল্প সংখ্যক স্বরধ্বনি নিয়েও আরবি একটি সমৃদ্ধ ভাষা । আর, কোন ভাষায় যত কম সংখ্যক স্বরধ্বনি থাকে সেই ভাষা উচ্চারণ করা তত সহজ । তাই আরবি উচ্চারণ তুলনামূলক ভাবে সহজ অন্য ভাষার চেয়ে ।
৪। আরবি প্রধানত ৩-বর্ণের মূল ভিত্তিক (trilateral root system) ভাষা অর্থাৎ এর বেশিরভাগ শব্দই তৈরি হয়েছে ৩-বর্ণের শব্দমূল থেকে । যদিও অন্যান্য ভাষায়ও মূল ভিত্তিক এই নিয়ম আছে কিন্তু আরবি ভাষার মত এত সুশৃঙ্খল, সঙ্গতিপূর্ণ (consistent) নয় । আরবিতে একই মূল থেকে আগত সকল শব্দের অর্থ এতই সঙ্গতিপূর্ণ যা অন্য ভাষায় বিরল । তাই আরবি যেকোন বড় শব্দকে ভেঙ্গে এর শব্দমূলকে চিনতে পারলে ঐ শব্দের অর্থ আন্দাজ করা খুব সহজ । নিচের উদাহরণটি দেখলে বিষয়টি সহজে বুঝা যাবে । এখানে একটি শব্দমূল “কাফ-তা-বা = লেখা” থেকে আগত শব্দগুলোর একটা তালিকা দেয়া হল ।
শব্দমূলঃ কাফ-তা-বা =লিখা থেকে আগত শব্দগুলো [সূত্রঃ Al-'Asr Institute]
৫। আরবি ৩-বর্ণের মূল ভিত্তিক এই সঙ্গতি (consistency) শুধুমাত্র শব্দমূল পর্যায়েই নেই এমনকি বর্ণ পর্যায়েও ধরে রেখেছে, যেটা অন্যান্য ভাষায় খুবই বিরল । আরবি প্রতিটি শব্দমূলের যেমন স্বতন্ত্র কিছু অর্থ আছে তেমনি আরবি প্রতিটি বর্ণও স্বতন্ত্র কিছু অর্থ বহন করে এবং চমকপ্রদ বিষয় হচ্ছে শব্দমূলের অন্তর্গত বর্ণগুলোর অর্থ মিলালে ঐ শব্দমূলের অর্থও অনুমান করা যায় । যেমন একটা উদাহরণ দেখি । শীন = ছড়ানো (spread/disperse), মীম = কিছু/জিনিস (being/thing), সিন = শক্তির প্রবাহ (energy flow) । এই ৩টি বর্ণ থেকে হয় শামস্ = সূর্য অর্থাৎ এমন কোন জিনিস যা থেকে শক্তি চারদিকে ছড়িয়ে পরে । কী চমৎকার ভাবে শব্দের অর্থ এর অন্তর্গত বর্ণগুলোর অর্থের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ !
৬। আরবি একটি খুবই সংক্ষিপ্ত (concise) ভাষা । অর্থাৎ অল্প শব্দ ব্যবহার করে এতে অনেক ভাব প্রকাশ করা যায় । বাংলায় পুরো একটা বাক্য আরবিতে একটি শব্দ দিয়েই লিখে ফেলা যায় । নিচের উদাহরণটি দেখুন । বাংলায় একটি বাক্য “অতঃপর আমরা তাদেরকে করে দিলাম” কে আরবিতে একটি শব্দ “ফাজা’আলনাহুম” দিয়ে প্রকাশ করা হয়েছে ।
৭। বিশ্বের প্রচলিত ভাষাগুলিতে সাধারণত দুটি ক্যাটেগরি; ব্যাকরণ-ভিত্তিক (grammar based) এবং উচ্চারণ/ধ্বনি-ভিত্তিক (phonetic based) এর মধ্যে যেকোন একটি প্রাধান্য পায় । আরবি ভাষা এই দুটি ক্যাটেগরির মধ্যে চমৎকার একটা ভারসাম্য বজায় রেখেছে অর্থাৎ আরবি ভাষাতে এই দুটি ক্যাটেগরিই গুরুত্ব পায় । আরবি ভাষায় যেমন ব্যাকরণের নিয়মগুলো সুশৃঙ্খল, সঙ্গতিপূর্ণ (consistent) তেমনি আরবি বর্ণের উচ্চারণগত পার্থক্য এবং এই পার্থক্যের নিয়মগুলোও সুশৃঙ্খল, সঙ্গতিপূর্ণ (consistent)। আমরা জানি বাংলার মত আরবিতেও কাছাকাছি উচ্চারণের কিছু বর্ণ আছে (যেমন কাফ, ক্বফ) । বাংলায় কাছাকাছি উচ্চারণের দুটি শব্দ যেমন “পরে” (later) এবং “পড়ে” (study) এর মধ্যে অর্থ ও উচ্চারণগত পার্থক্য আছে তেমনি আরবিতেও এমন শব্দ আছে । তবে আরবিতে এই উচ্চারণগত পার্থক্যের কারণ ও নিয়মগুলোও সুশৃঙ্খল । যেমন একটি উদাহরণ দেখি । কালাম (কথা) ও ক্বলাম (কলম); এই দুটি শব্দের মূলে আছে যথাক্রমে কাফ-লাম-মীম ও ক্বফ-লাম-মীম (শুধু ১ম বর্ণে পার্থক্যে) । কিন্তু কেন কথায় কাফ এবং কলমে ক্বফ হলো ? এটারও একটা চমৎকার কারণ আছে । ‘কালাম’ উচ্চারণে হালকা কিন্তু ‘ক্বলাম’ উচ্চারণে ভারী; ঠিক যেমন কালাম (কথা) ওজনে হালকা (বায়বীয়) কিন্তু ক্বলাম (কলম) ওজনে ভারী (কঠিন বস্তু) । এভাবে আরবি উচ্চারণের এই পার্থক্যেগুলোও সুশৃঙ্খল নিয়মের মধ্যে ফেলা যায় যা অন্য ভাষায় বিরল ।
৮। আরবি উচ্চারণ সহজ এবং শ্রুতিমধুর । বিশেষ করে, কোরআনের তিলাওয়াত দীর্ঘক্ষণ শুনলেও কোন রকম বিরক্তি আসে না । এর তিলাওয়াতে এক সম্মিহনী ক্ষমতা আছে । উমর (রাঃ) এর ইসলাম গ্রহণের সময়ের ইতিহাস তো আমরা সবাই জানি । তরবারি হাতে রসূল (সাঃ) কে হত্যা করতে এসে কোরআনের তিলাওয়াত শুনতে পেয়ে উনার কঠিন হৃদয় গলে গেল এবং ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণ করেন । ইতিহাসের পাতায় এমন অজস্র ঘটনা আছে যেখানে শুধু কোরআনের তিলাওয়াত শুনে অনেক মানুষ ইসলাম গ্রহণ করেছেন ।
অর্থ বুঝে কোরআন পড়া কতটা সহজ?
আমরা আগের অনুচ্ছেদে দেখলাম আরবি ভাষার কিছু অনন্য বৈশিষ্ট্য । আল্লাহ্ এই আরবি ভাষাকে মনোনীত করলেন কোরআনের ভাষা হিসাবে এবং ঘোষণা দিলেন এটি বোঝার জন্য সহজ । আল্লাহ্ বলেন -
- “শপথ সুস্পস্ট কিতাবের । আমি একে করেছি কোরআন, আরবি ভাষায়, যাতে তোমরা বুঝ ।” [আয-যুখ্রুফ ৪৩:২-৩]
- আমি কোরআনকে সহজ করে দিয়েছি বোঝার জন্যে । অতএব, কোন চিন্তাশীল আছে কি ? (কামার ৫৪:১৭, ২২, ৩২, ৪০)
কিন্তু আরবি কি আসলেই সহজ ভাষা ? আল্লাহ্ যেহেতু বলেছেন তাহলে অবশ্যই এটি সহজ ভাষা । তবে ভাষা হিসাবে আরবি যেমনই হোক না কেন আল-কোরআনে আল্লাহ্ যে আরবি ভাষা ব্যবহার করেছেন তা অবশ্যই সহজ । যেমন দেখুন, পুরু কোরআনে মোট শব্দ আছে ৭৭,৪২৯ টি । কিন্তু পুনারাবৃত্তি আর একই শব্দের বিভিন্ন ব্যাবহারগুলো বাদ দিলে শব্দ সংখ্যা দাড়ায় মাত্র ৪৮৪৫ টি । এর মধ্যে বেশিবার ব্যবহৃত মাত্র ৬০টি শব্দের অর্থ জানলেই পুরু কোরআনের মোট শব্দের অর্ধেক (৫০%) শব্দের সাথে আমাদের পরিচয় হয়ে যাবে ইনশা-আল্লাহ্ । আরও ২৫% শব্দের অর্থ জানতে আর মাত্র ২৬০ টি শব্দের সাথে পরিচিত হতে হবে । অর্থাৎ মাত্র ৩২০টি শব্দ শিখে আমরা কোরআনের ৭৫% অংশের শাব্দিক অর্থ বুঝতে পারবো । সুবহানাল্লাহ ! বিস্ময়কর ভাবে কত অল্প সংখ্যক শব্দ ব্যবহার করে আল্লাহ এই বিশাল কোরআনের বেশির ভাগ অংশ সাজিয়েছেন! অল্প কিছু আরবি শব্দের অর্থ জানলেই কোরআনের বেশির ভাগ অংশের শাব্দিক অর্থ বুঝা যাবে ইনশা আল্লাহ্ । আমাদের বুঝার জন্য কোরআনকে আল্লাহ কত সহজ করে নাজিল করেছেন !
নিচে কোরআনের সর্বাধিক ব্যবহৃত ১০০টি শব্দের বিন্যাস দেয়া হলো । এই ১০০টি শব্দ মনে রাখতে পারলে পুরু কোরআনের প্রায় ৬০% অংশের সাথে আমাদের পরিচয় হয়ে যাবে ইনশা আল্লাহ্!!
সামনের অধ্যায়গুলোতে আমরা ধীরে ধীরে আল-কোরআনের এই সর্বাধিক ব্যবহৃত শব্দগুলোর সাথে পরিচিত হবো এবং কোরআনে এগুলোর ব্যাবহার দেখবো ইনশা-আল্লাহ ।
******************************************************************************
PDF download এর জন্য এখানে ক্লিক করুন
আগের অধ্যায় সুচীপত্র ও ভূমিকা
পরের অধ্যায় পরের অধ্যায় ৩। বিসমিল্লাহ্ বলে শুরু করি
******************************************************************************
অর্থ বুঝে কোরআন পড়ি (পর্ব আকারে)
*****************************************************************************
আল-কুরআনের সর্বাধিক ব্যবহৃত শব্দগুলোর ছবি/PDF download করতে এখানে ক্লিক করুন
সর্বশেষ পরিমার্জন ১০-০৬-২০১৯
No comments:
Post a Comment