কুরআনের মাইন্ড ম্যাপ (পর্ব-২) ২। বাকারা (গাভী)

 



PDF Download (Google Drive থেকে)


বাকারা (গাভী)

এটি মাদানি সূরা। মোট আয়াত সংখ্যা ২৮৬

নামকরণঃ

অত্র সূরার ৬৭ থেকে ৭৩ নং আয়াতে গাভী নিয়ে এক ঐতিহাসিক ঘটনা বর্ণনা করা হয়েছে । সেখান থেকেই এই নামকরণ করা হয়েছে।

আলোচ্য বিষয়ঃ

·    প্রথমেই কুরআনের অনন্যতার উল্লেখ করা হয়েছে। বলা হয়েছে যে এতে কোন সন্দেহ নেই পরবর্তীতে, আয়াত ২৪-২৫ এ চ্যলেঞ্জ করা হয়েছে যে, যদি কারো সন্দেহ থাকে তবে একটি সূরা নিয়ে আস [২, ২৩-২৪]

·    আয়াত ৩-২০ এ মুমিন, কাফির এবং মুনাফিকদের বৈশিষ্ট্য আলোচিত হয়েছে [৩-২০]















কুরআনের মাইন্ড ম্যাপ (পর্ব-১)

 


মাইন্ড ম্যাপ কী?

সহজে তথ্য মনে রাখার অনেক কার্যকর একটি পদ্ধতি হল ‘মাইন্ড ম্যাপ’[1] এর আবিস্কারক টনি বুজান বর্তমানে এটিকে বিশ্বের অন্যতম সেরা ও কার্যকারী  থিংকিং টুল হিসাবে গন্য করা হয় এটি তথ্যগুলো বড় ছবিসহ বিস্তারিত দেখার চমৎকার এক উপায়। ছবি মানুষের স্মৃতিতে বেশি স্থায়ী হয় তাই প্রতিটি মাইন্ট ম্যাপ শুরু হয় কেন্দ্রে একটি ছবি দিয়ে তারপর এর থেকে শাখা প্রশাখার বিস্তার করে তথ্যগুলো ছবির মাধ্যমে গেঁথে নেয়া হয়। ছবি সাজিয়ে ভাল করে ম্যাপটি আকতে পারলে এখান থেকে একটির পর একটি তথ্য মনে করা যায়; কান টানলে যেমন মাথা আসে তেমনি ভাবে

এখানে আল-কুরআনের সকল সূরার ‘মাইন্ড ম্যাপ’ করার চেস্টা করা হল। তবে এখানে ছবির ব্যবহার করা হয়নি; সুরার মূল আলোচ্য বিষয়গুলো কয়েকটি ভাগে ভাগ করে সাজানো হয়েছে এই মাইন্ড ম্যাপগুলো পুরোপুরি বুঝে মনে রাখতে হলে প্রথমে সূরাগুলোর বাংলা অনুবাদ পড়ে নিতে হবে


৫৭ হাদীদ

সূরা হাদীদ মাক্কী সূরা। মোট আয়াত সংখ্যা ২৯ এই সুরায় আল্লাহ্‌ ও তাঁর রাসুলদের প্রতি ঈমান আনা এবং দানের ব্যাপারে গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে ঈমানের প্রতিদানে আল্লাহ্‌ মহাপুরস্কার (জান্নাত) এবং নূর প্রদানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন  আর দান, আল্লাহ্‌কে দেয়া উত্তম ঋণ-এর সাথে তুলনা করেছেন এবং এর প্রতিদান বহুগুণ বৃদ্ধি ও সম্মানজনক পুরষ্কারের কথা বলেছেন। এই সূরার নাম বাংলায় ‘লোহা’ কারণ এর ২৫ নং আয়াতে লোহার ব্যাপারে বলা হয়েছে যে এটি আল্লাহ্‌ নাযিল করেছেন (অর্থাৎ লোহা পৃথিবীর কোন উপাদান নয়; বরং পৃথিবীর বাইরে থেকে এটি পাঠানো হয়েছে) যাতে আছে প্রচণ্ড শক্তি এবং মানুষের জন্য বহুবিধ উপকার

 

কিছু চুম্বক আয়াত

 

আসমানসমূহ ও যমীনে যা কিছু আছে, সবই আল্লাহর তাসবীহ পাঠ করে। আর তিনি পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।[৫৭:১]

এমন কে আছে যে, আল্লাহকে উত্তম ঋণ দিবে? তাহলে তিনি তার জন্য তা বহুগুণে বৃদ্ধি করে দিবেন এবং তার জন্য রয়েছে সম্মানজনক প্রতিদান।[৫৭:১১]

তোমরা জেনে রাখ যে, দুনিয়ার জীবন ক্রীড়া কৌতুক, শোভা-সৌন্দর্য, তোমাদের পারস্পরিক গর্ব-অহঙ্কার এবং ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততিতে আধিক্যের প্রতিযোগিতা মাত্র। এর উপমা হল বৃষ্টির মত, যার উৎপন্ন ফসল কৃষকদেরকে আনন্দ দেয়, তারপর তা শুকিয়ে যায়, তখন তুমি তা হলুদ বর্ণের দেখতে পাও, তারপর তা খড়-কুটায় পরিণত হয়। আর আখিরাতে আছে কঠিন আযাব এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে ক্ষমা ও সন্তুষ্টি। আর দুনিয়ার জীবনটা তো ধোকার সামগ্রী ছাড়া আর কিছুই নয়[৫৭:২০] 

তোমরা তোমাদের রবের পক্ষ থেকে ক্ষমা ও সেই জান্নাতের দিকে প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হও, যার প্রশস্ততা আসমান ও যমীনের প্রশস্ততার মত। তা প্রস্তত করা হয়েছে যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলদের প্রতি ঈমান আনে তাদের জন্য। এটা আল্লাহর অনুগ্রহ। তিনি যাকে ইচ্ছা তা দান করেন। আর আল্লাহ মহা অনুগ্রহশীল।[৫৭:২১]





৮৯ ফজর

সূরা ফজর (ভোর), আল-কুরআনের ৮৯ নং সূরা। এটি মাক্কী সূরা। মোট আয়াত সংখ্যা ৩০ এই সুরায় প্রথমেই আল্লাহ্‌ ফজর বা ভোরের শপথ করেছেন; তাই এই সূরার নাম ফজর এখানে পূর্ববর্তী যুগের ৪ টি জাতির কাফিরদের পরিণতি স্মরণ করে দিয়েছেন এছাড়াও এই সুরায় আল্লাহ্‌ মানুষের স্বরূপ, যেমন দারিদ্রে ও প্রাচুর্যে মানুষের অবস্থা, সম্পদের প্রতি অত্যধিক ভালোবাসা, আখিরাতে কাফিরদের অনুতাপ ও অনুশোচনা, মুমিন ও কাফিরদের প্রতিদান নিয়ে আলোচনা করেছেন




৮৫ বুরুজ

সূরা বুরুজ, আল-কুরআনের ৮৫ নং সূরা। এটি মাক্কী সূরা। মোট আয়াত সংখ্যা ২২ এর ১ম আয়াতে ব্যবহৃত “বুরুজ” যার অর্থ গ্রহ-নক্ষত্র বা রাশিচক্র থেকে সূরাটির নামকরন করা হয়েছে।  এই সূরাটির কেন্দ্রীয় আলোচ্য বিষয় “ঈমানের উপর অবিচলতা” ইসলাম প্রচারের শুরুর দিকে যখন মক্কার কাফিররা মুসলিমদের ঈমান চূত করার জন্য চরম অত্যাচার করছিল সেই সময় এই সূরাটি নাযিল হয়। এই সূরার মাধ্যমে আল্লাহ্‌ একদিকে যেমন কাফিরদের সতর্ক করেছেন অপরদিকে মু’মিনদেরকে সাহস ও সান্তনা দিয়েছেন। এখানে আল্লাহ্‌ পুর্ববর্তী যুগের কাফিরদের পরিনতির কথা স্মরণ করে দিয়েছেন । যেমন বিশেষ করে গর্তওয়ালা বা আসহাবুল উখদূদদের কথা যারা ঈমানদারদের আগুনের গর্তে ফেলে হত্যা করেছিল শুধুমাত্র এই কারণে যে তারা আল্লাহ্‌র উপর ঈমান এনেছিল। আল্লাহ্‌র তাদেরকে ধ্বংস করেছেন; তাদের ঠিকানা নিশ্চিত জাহান্নাম । অপরদিকে, ইমানদাররা নিজেদের জীবন বিলিয়ে দিয়েছে কিন্তু ঈমানহারা হয়নি; তাদের গন্তব্য নিশ্চিত জান্নাত। 



৭৩ মুজ্জাম্মিল (বস্ত্রাবৃত)

সূরা মুজ্জাম্মিল, আল-কুরআনের ৭৩ নং সূরা। এটি মাক্কী সূরা। মোট আয়াত সংখ্যা ২০ এর ১ম আয়াতে আল্লাহ রাসূল সা:কে মুজ্জাম্মিল নামে সম্মোধন করেন পুরো সূরা জুড়েই আল্লাহ রাসূল সা:কে বিভিন্ন নির্দেশনা দেন এই সূরার মাধ্যমে তাহাজ্জুত নামাজের গুরুত্ব এবং এটি সবার জন্য ফরজ হয় পরে শেষ আয়াতের মাধ্যমে এটি ফরজের বিধান রহিত করা হয় এছাড়াও ৩ অবস্থায় ফরজ নামাজ সহজ করা হয়; অসুস্থতায়, সফর, যুদ্ধকালীন

 


৮৬ ত্বরিক (রাতে আগমনকারী, উজ্জ্বল নক্ষত্র)

এটি মাক্কী সূরা। মোট আয়াত সংখ্যা ১৭ আল্লাহ এই সূরাটির শুরুতে উজ্জ্বল নক্ষত্রের কসম করেন তাই এই নাম। এই সুরায় আল্লাহ্‌, মানুষের স্বরূপ নিয়ে চিন্তা ভাবনা করতে বলেছেন, বান্দার সকল আমলের সংরক্ষণ, মৃতুর পর পুনরুত্থান, কুরআনের মর্যাদা এবং কাফিরদের প্রতি আল্লাহ্‌র ধমকি নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।


৮৭ আ’লা (সুউচ্চ)

এটি মাক্কী সূরা। মোট আয়াত সংখ্যা ১৯ আল্লাহর একটি গুণবাচক নাম ‘আ’লা’ বা সুউচ্চ, সুমহান। এই সূরাটির শুরুতেই আল্লাহ্‌ তাআলা তাঁর এই গুণবাচক নামের পবিত্রতা বর্ণনা করার নির্দেশ দিয়েছেন, তাই সূরার এই নাম। এই সুরাটিতে তিনটি বিষয়ের অবতারণা করা হয়েছে। ১। তাওহিদ (আল্লাহ্‌র নামে তাসবীহ পাঠ করো), ২। রাসুলুল্লাহ সাঃ-কে উপদেশ দান, ৩। আখিরাত।  এটি একেবারে প্রথম দিকে অবতীর্ণ সুরাগুলোর অন্যতম এর ৬নং আয়াতে ‘আমি তোমাকে পড়িয়ে দেবো, তারপর তুমি আর ভুলবে না’- এ বাক্যটি এ কথা জানিয়ে দিচ্ছে যে, এটা এমন সময়ে নাযিল হয়েছিল, যখন রাসূল সাঃ ভালোভাবে ওহি আয়ত্ব করার অভ্যাস গড়ে তুলতে পারেননি এবং ওহি ভুলে যাবার আশঙ্কা করতেন তাই আল্লাহ্এখানে রাসুল সাঃ কে উপদেশ দিয়ে আশ্বস্ত করেন যে ওহি তাঁর স্মৃতিপটে সংরক্ষিত করে দেয়া আল্লাহ্র দায়িত্ব সুতরাং এ নিয়ে চিন্তা করার কোন কারণ নেই রাসূল সাঃ-এর কাজ শুধু উপদেশ পৌঁছে দেয়া সূরাটির শেষ অংশে বলা হয়েছে, সাফল্য কেবল তাদের জন্য যারা ঈমান, কর্মে ও চরিত্রে পবিত্রতা ও নিষ্কলুষটা অবলম্বন করবে, রবের নাম স্মরণ করবে এবং সালাত আদায় করবে কিন্তু মানুষ আখিরাত বাদ দিয়ে দুনিয়াকে নিয়ে ব্যস্ত যেখানে দুনিয়া ক্ষণস্থায়ী ও আখিরাত চিরস্থায়ী এই সত্যটি শুধু কুরআনেই বলা হয়নি, ইব্রাহীম আঃ ও মুসা আঃ-এর সহিফাসমূহেও বলা হয়েছিল

৮৮ গাশিয়াহ

এটি মাক্কী সূরা। মোট আয়াত সংখ্যা ২৬ ‘গাশিয়াহ’ অর্থ মহাপ্রলয়, কিয়ামত, আচ্ছাদনকারী (কিয়ামত সব মানুষকেই আচ্ছাদন/পরিবেস্টন করে নেয়) । এটি একেবারে প্রথম দিকে অবতীর্ণ সুরাগুলোর অন্যতম এটি এমন সময় নাযিল হয় যখন রাসুল সাঃ ব্যাপকভাবে ইসলাম প্রচার শুরু করেন এবং মক্কার লোকেরা তাঁর দাওয়াত উপেক্ষা করতে থাকে। এই সূরায় কিয়ামত দিবসে জান্নাতি ও জাহান্নামি মানুষদের অবস্থা বর্ণনা করা হয়েছে এবং আখিরাতে তাদের পরস্কার ও শাস্তির বর্ণনা করা হয়েছে । তারপর আল্লাহ্‌র দেয়া দুনিয়ার চারটি নিদর্শন নিয়ে চিন্তা ভাবনা করতে বলেছে। সবশেষে রাসূল সাঃ-কে সান্ত্বনা দিয়ে বলা হয়েছে যে, তাঁর কাজ শুধু উপদেশ পৌঁছে দেয়া; তিনি তাদের উপর কোন শাসক বা কতৃত্বকারী নন যারা মুখ ফিরিয়ে নেয়, কুফরি করে তাদের হিসাব নিকাশ আল্লাহ্রই হাতে ন্যস্ত




৬১ ছফ (সারিবদ্ধ)

এটি মাদানি সূরা। মোট আয়াত সংখ্যা ১৪

নামকরণঃ

 الصف শব্দের অর্থ : কাতার বাঁধা, সারিবদ্ধ হওয়া শব্দটি অত্র সূরার চতুর্থ আয়াতে উল্লেখ রয়েছে। এই সূরায় মু’মিনদের একটি গুণ বর্ণনা করা হয়েছে যে তারা জিহাদে সারিবদ্ধ হয়ে দাড়ায়। সেখান থেকেই এ নামে সূরার নামকরণ করা হয়েছে।

নাযিলের প্রেক্ষাপটঃ

আবদুল্লাহ ইবন সালাম রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, একদল সাহাবী পরস্পরে আলোচনা করলেন যে, আল্লাহ তা'আলার কাছে সর্বাধিক প্রিয় আমল কোনটি আমরা যদি তা জানতে পারতাম, তবে তা বাস্তবায়িত করতাম। তখন রাসূলুল্লাহ সাঃ তাদেরকে সমগ্র সূরাটি পাঠ করে শুনিয়ে দিলেন, যা তখনই নাযিল হয়েছিল সম্ভবত ওহুদ যুদ্ধের সমসাময়িক কালে এটি নাযিল হয়েছিল।

আলোচ্য বিষয়ঃ

·       কথায় ও কাজে অমিল নিন্দনীয়এটা মু’মিনের বৈশিষ্ট্য নয়[২, ৩]

·       মানুষের একটি গুনাহের শাস্তিস্বরূপ পরবর্তীতে আরও গুনাহে লিপ্ত হয়। []

·       ঈসা আঃ কর্তৃক মুহাম্মদ সাঃ-এর আগমনের সুসংবাদ প্রদান। [৬]

·       আল্লাহ্‌র সম্পর্কে মিথ্যা বলা সবচেয়ে বড় জুলুম। [৭]

·       আল্লাহ্‌ তা’আলা সকল দ্বীনের উপর ইসলামকে বিজয়ী করবেন, যতই কাফির-মুশরিকরা প্রতিহত করার চেস্টা করুক[৮, ৯]

·       ঈমানের পর জিহাদ করা সর্বোত্তম আমল। ঈমান আনা ও জিহাদ করা বান্দার জন্য সর্বাধিক লাভজনক ব্যবসা। [১০-১৩]

·       আল্লাহ্‌র রাস্তায় সহযোগিতা করা মু’মিনের পরিচায়ক। আল্লাহ্‌ তাদেরকে বিজয়ী করবেন [১৪]

কিছু চুম্বক আয়াত

 

হে মু’মিনগণ! তোমরা এমন কথা কেন বল যা তোমরা কর না [৬১:২] 

হে মু’মিনগণ! আমি কি তোমাদেরকে এমন এক ব্যবসায়ের সন্ধান দিব, যা তোমাদেরকে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি থেকে মুক্তি দেবে? আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান আনবে এবং তোমরা তোমাদের ধন-সম্পদ ও জীবন দিয়ে আল্লাহর পথে জিহাদ করবে। এটাই তোমাদের জন্য কল্যাণকর, যদি তোমরা জানতে। [৬১:১০-১১]






[1] আনলিমিটেড মেমোরি, কেভিন হোর্সলি, অনুবাদঃ ত্বাইরান আবির, চর্চা গ্রন্থ প্রকাশ্‌ ২০১৯|